যাত্রাপালা…যাত্রাপালা…যাত্রাপালা… মাগুরাতে যাত্রাপালা!

মাগুরানিউজ.কমঃ

যাত্রাপালার একটি দৃশ্য
যাত্রাপালার একটি দৃশ্য

প্রায় মধ্যরাত। গ্রামবাংলা সুনসান নিরব। দূর-বহুদূর থেকে ভেসে আসছে যন্ত্র সঙ্গীতের সুমধুর সুরমূর্ছনা।

কিছুক্ষণ পরেই সেই উদাত্ত কন্ঠের সংলাপ। ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি দাদু তুমি বলেছিলে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রশ্রয় দেবো না..। অথবা সেই দরদী কন্ঠের ‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো’ যাত্রাপালার গান আর সংলাপ শোনা যায় না।

নিকট অতীতে সত্তরের দশকেও মফস্বল শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ উম্মুখ থাকতো কবে শুরু হবে যাত্রাপালার মৌসুম। তখন এই যাত্রাপালাই ছিল গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের প্রধান খোরাক। গ্রামের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক একটা আর্থিক সহযোগিতার উৎস ছিলো যাত্রাপালা। বলা হতো অমুক স্কুলের উন্নতিকল্পে যাত্রাপালা চলছে।

যাত্রা শিল্পীদের কঠিন ঠাঁটবাট জৌলুস ছিলো তখন। মাগুরার মোবাইল গ্যালারির রনি রায় স্মৃতি হাতড়ে বলেন, তখন খুব ছোট। প্রাইমারিতে পড়ি। আসলো জনতা অপেরা। রাতে তো অতো ছোট ছেলেদের যাত্রা দেখার সুযোগ ছিলো না। তাই দিনের বেলা যেতাম যাত্রার মানুষদের দেখতে। দেখতাম অনেক বেলা ঘুমাচ্ছে। আবার বিকেলে যেতাম দেখতে। সে সব মানুষ অন্যরকম। রাতে শুয়ে শুয়ে বাড়ি থেকে শোনা যেত। কান পেতে শুনতাম মায়ের কোলে শুয়ে।

ব্যবসায়ী রকিবুর রহমান বলেন, আমি আদি যাত্রাপালা দেখিনি। যখন যাত্রাপালায় প্রিন্সেসদের আমদানি হলো। বদলে গেলো যাত্রার আদিরূপ। তখন এলাকায় নয়। অন্য এলাকায় গিয়ে যাত্রা দেখেছি।

বলেন, তখনো পুরোপুরি যাত্রাপালা খ্যামটা নাচ আক্রান্ত হয়নি। দেখেছি- বেহুলা-লখিন্দর, রূপবান, বাবা কেন চাকর, নবাব সিরাজুদৌল্লা, সিঁথির সিঁদুর। তখন কোন এলাকায় যাত্রার প্যান্ডেল পড়লে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দেখতে আসতো। সারারাত যাত্রা দেখে সকালে ঝিমুতে ঝিমুতে বাড়ি ফিরতো। টিকিটের বিনিময়ে সেই যাত্রাতেও নাচ ছিলো। সুন্দর পরিশীলিত ছিলো সে নাচ। ছিলো না কোন অশ্লীলতা।

দিন বদলের আবর্তে মফস্বলে এলো সিনেমা হল। এলো সিডি, ডিভিডি। আর এখনতো ডিস লাইনের, চ্যানেলের যুগ।

অতীত স্মৃতির সন্ধান করে ভরত চন্দ্র জানান, ‘কি আর কবো ভাই। সে এক সময় ছিলো। কি অভিনয় শিল্পীদের। আর বড়বড় নামী যাত্রাদল। শাহজাদপুরের অমল বাবুর বাসন্তী অপেরা, যশোরের বাবুল অপেরা, খুলনার দিপালী অপেরা আসতো এখানে। আমি থাকতাম ডেকারেশনে।’

ভরত বলেন, ‘কোথায় গেলো সে সব যাত্রাদল। এখনো মনে হলে দেখতে ইচ্ছে হয়।’

ভরতের মতো অনেকেই আজো অতীত খুঁজে ফেরে। এখনো কালেভদ্রে কোথাও কোথাও বসে যাত্রার আসর। কিন্তু অপসংস্কৃতির সব রকম উপাদানই এখন ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন এক সময়ের যাত্রাদলের অধিকারী দীলিপ দাস।

বলেন, ‘তখন একটা শিল্পমাত্রায় বাঁধা ছিলো যাত্রা শিল্প। অশ্লীলতার সুযোগ ছিলো না। বাবার হাত ধরে ছোট ছেলে-মেয়েরা আসতো যাত্রা দেখতে। তখন ইতিহাস আশ্রয়ী কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালা বেশী হতো। মানুষ তা দেখে শিক্ষা নিতো।’

এক সময়ের তুখোড় যাত্রাভিনেত্রী অনিমা দাস বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর অভিনয় করেছি। মান-মর্যাদা ছিলো তখন যাত্রা শিল্পীদের। মানুষ সম্মান করতো আমাদের। আনন্দ নিয়ে, এক ধরনের শিল্পবোধ নিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেছিলাম। তারপর কি হলো সবাই-ই জানেন। ব্যাস ফিরে এলাম সংসার জীবনে। এখনতো সে যাত্রা আর নেই। এখন অতিমাত্রায় বিনোদন-নাচ-গান আসল যাত্রার রূপকে গিলে ফেলেছে।’

মাত্র তিন দশক আগেও যাত্রা দেখে মনোরঞ্জনের জন্য গ্রামের মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকতো। বড় খেলার মাঠ টিন অথবা চাটাই দিয়ে ঘিরে ফেলা হতো। মাঝখানে সামিয়ানা দিয়ে করা হতো বিশাল প্যান্ডেল। দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্য থাকতো কয়েকটি গেট। টিকিট ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্যান্ডেলে ঢোকানো হতো দর্শকদের। সারারাত চলতো যাত্রাপালা। বিরতির মাঝখানে চলতো নাচ-গান।

বাইরে বসতো বড় বড় চায়ের-ডিমের-জিলিপির-বাদামের দোকান। পাঁপর ভাজা-ঝালমুড়িসহ কত রকম দোকান। এক অন্যরকম আনন্দে মেতে উঠতেন গ্রামের মানুষ। এখন সে সবই স্মৃতি হয়ে গেছে সংস্কৃতিমোদী মানুষদের কাছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

December ২০২৩
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
« Nov    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

ফেসবুকে আমরা

বিভাগ

দিনপঞ্জিকা

December ২০২৩
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
« Nov    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
%d bloggers like this: