মাগুরানিউজ.কমঃ
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। উঠানের এক কোণে মাটির উনুনে তখনো ভাতের হাঁড়িতে চাল ফুটছে। ধোঁয়াচ্ছন্ন উনুনের এক পাশে বসে আছেন লাইলি বেগম। উনুনের আগুন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে অবিরত ভেতরে ঠেলছেন পাটকাঠি। এ যেন সুদীর্ঘ ৪২ বছর ধরে বহমান কষ্টক্লিষ্ট জীবন-সংগ্রামেরই প্রতীকী চিত্র।
এত দেরিতে রান্নার কারণ জানতে চাইলে খুব সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের বীরাঙ্গনা লাইলি বেগমের। জানালেন, কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে চলছে সংসার। স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন একসময় রিকশা ভ্যান চালিয়ে সংসার টানতেন। এখন শারীরিক কারণে বেকার। বাবার মতো একইভাবে ভ্যান চালিয়ে এখন সংসার টানে দুই ছেলে খোকন ও সোহাগ। তাদের সারা দিনের আয়ে কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন পাঁচ ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আট সদস্যের এই সংসারের সবাই।
বীরাঙ্গনা লাইলি বেগমের কাছ থেকে জানা যায়, বেশির ভাগ দিন সকাল বেলা চলে ভাত ও পেঁপে সিদ্ধ দিয়ে। পরের বেলা বিকেলে চলবে ভাত ও শাক-সবজি দিয়ে। দুবারের বেশি রান্না কোনোদিনই হয় না। মাছ-মাংস বিশেষ কোনো দিন ছাড়া একেবারেই জোটে না। আর মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে একচিলতে জমি ও ভাঙাচোরা দুই খানা টিনের ঘর। লাইলি বেগম বলেন, ‘সারা জীবন শুধু শুনিই গেলাম বীরাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা। বিয়াল্লিশ বছরে একখান কাগজ (সনদ) পর্যন্ত পালাম না। এই শুনি অমুকের ঠাহা দিচ্ছে, তমুকের ঘর দিচ্ছে। আমাগের দিকি তো কেউ মুখ তুলে চায় না! আমার কথা নাই বাদই দিলাম। আমার স্বামী তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে। একখান কাগজের জন্যি মেলা বছর ধরে সেই তো দুয়োরে দুয়োরে ঘুরতিচে।’
লাইলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আসলে কেউ কারুর না। নিজির মা-বাপ, তাঁরাই আর খবর নিল না! যুদ্ধের পর কোনোদিন আর বাপের বাড়ি যাতি পারলাম না। মরার সময় তাগের মুখখান পর্যন্ত দেখতি পারলাম না।’মা-বাবার কথা উঠতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন লাইলি বেগম।
জানা গেল, পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের খবর পেয়ে লোকলজ্জার ভয়ে লাইলির বাবা একই উপজেলার রায়নগর গ্রামের মোবারক মোল্যা ও মা ফুলজান বেগম আর কোনোদিন তার খোঁজ নেননি। এমনকি বাবার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারেও তাঁরা নিষেধ করেছেন। তাঁরা কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু লাইলি বেগমের সবচেয়ে ভয় ছিল যাকে নিয়ে, সেই মুক্তিযোদ্ধা স্বামী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘরে ফিরে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি ও তাঁর ভাই মশিউর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণেই পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাঁদের বাড়ি টার্গেট করেছিল। কাউকে না পেয়ে নববধূ লাইলিকে ধরে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল। সুতরাং এ দায় লাইলির নয়। এ দায় বরং তাদের সবার।
সেদিনের ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় শ্রীপুরের মদনপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্বামী যশোর অঞ্চলে ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর শ্রীপুর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন মিয়ার দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে যুদ্ধে যান তাঁর দেবর মশিউর। পাকি সেনাদের শ্রীপুর অঞ্চলের ক্যাম্পটি ছিল তাঁদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। যুদ্ধের শেষভাগে এক দুপুরে হঠাৎ গুলির শব্দে গোটা গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় ছয়-সাতজনের একদল পাকি সেনা লাইলি বেগমের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে তাড়া করে। আতঙ্কিত লাইলি প্রতিবেশী আনোয়ারুল কবির আজমের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সেনারা লাইলিকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য আনোয়ারুল আজম ও তাঁর স্ত্রীকে গালাগাল করে ও অস্ত্র তাক করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।আনোয়ারুল আজম সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে পাকি সেনারা টেনে-হিঁচড়ে লাইলিকে ঘর থেকে বের করে পাশের জঙ্গলে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে তাঁর এক দাদা শ্বশুর অচেতন অবস্থায় তাঁকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে চিকিৎসা দেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর স্ত্রী লাইলির মতো বীরাঙ্গনাদের ত্যাগকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। কিন্তু কষ্ট পান যখন ভাবেন, এঁদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। এমনকি সরকারিভাবে তাঁদের স্বীকৃতি পর্যন্ত জোটেনি।মনোয়ার হোসেন মোল্যার দাবি, শুধু সরকারি স্বীকৃতি নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বীরাঙ্গনাদেরও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। একই দাবি লাইলির ছেলে খোকন মোল্যা, সোহাগ মোল্যাসহ অন্যদের।
মনোয়ার হোসেন মোল্যা এ প্রসঙ্গে আরো জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তিনি শ্রীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা লাইলি বেগমের মতোই। একটি সনদের জন্য এখনো সংগ্রাম করছেন তিনি। একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী লাইলি বেগম ইট ভাঙার কাজ পর্যন্ত করেছেন। অন্যের কামলা খেটেছেন। নিজে ভ্যান চালিয়েছেন। এখন শারীরিক ক্ষমতা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে বিনা বেতনে কাজ করছেন। সংসার চলছে ছেলেদের ভ্যান চালনার টাকায়।
লাইলি বেগমের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়া বলেন, ‘লাইলির ঘটনার পরপরই আমাদের কাছে খবর আসে; কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না। তবে পরবর্তী সময়ে সে যাতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, সে ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠিয়েছি। এখনো কোনো ফল পাইনি। তার স্বামীর ব্যাপারে একইভাবে চেষ্টা চলছে। সে আমার অধীনেই যুদ্ধ করেছিল।’