মাগুরানিউজ.কমঃ
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সূক্ষ্ণ যে মিলনভূমি বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। তেমন ধরণের কিংবদন্তী এটি। সংজ্ঞা অনুসারে ঠিক আছে। কিংবদন্তীর একটি বিশেষ মটিভ হলো পরীদের গল্প। কুলু কুলু রবে বয়ে চলেছে মধুমতি। মাগুরা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। মহম্মদপুর উপজেলার একটি গ্রামের নাম পাল্লা। পাল্লাতে একটি হাইস্কুল আছে। এটি মধুমতি নদীর পাড়ে অবস্থিত। পাল্লাস্কুল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সোজা পূর্ব দিকের নদীর বিশালতা অনেক বেশি। আর এককালে পানির গভীরতাও ছিল অনেক। বর্তমানেও সেখানে পানির গভীরতা অনেক বলে জানা যায়।
অনেক দিন আগের কথা মধুমতির এ গভীর পানিতে নাকি পরীর দালান ছিল। এ দালানটি নাকি একবার নদীর পানি কমে গেলে কিছু অংশ ভেসে উঠেছিল। এ দালানের মধ্যে পরীরা বাস করত বলে শুনা যায়। মধুমতির পূর্ব পাড়ের নাম কালীতলা। সেখানে এককালে অনেক হিন্দু ধনী লোকের বসবাস ছিল। তাদের ছিল অনেক দালান কোটা। কয়েকদিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তবে একটি দালান অক্ষত অবস্থায় নদী ভাঙ্গনের কারণে পুতে যায়। নদীর স্রোতের দালানের আশে পাশের মাটি সরিয়ে নিয়ে যায়। আর নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে অক্ষত দালানটি। পরীরা সব জায়গায় বিচরণ করতে পারে। তাই এ দালানে পরীরা এসে আস্তানা করে।
একবার নদীতে ভীষণ তুফান হচ্ছিল। হঠাৎ একটি জেলে নৌকা কালীতলার গভীর জলে ডুবে যায়। নৌকার সাথে জেলেও ডুবে যায়। এক সময় পানির নীচে ইটের মত শক্ত কিছু তার হাতে পড়ায় তা ধরার জন্য চেষ্টা করে। অনেক চেষ্টা করে সে জালনার একটি সিক ধরে ফেলে। সিকে হাত পড়ায় সে বুঝতে পারে যে এটি দালান। জেলে আবার একজন ভাল ডুবুরিও ছিল। দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকার মন্ত্র নাকি সে জানতো। জেলে দালানের দরজা খোঁজার জন্য মন্ত্র পড়ে আস্তে আ হাত দিয়ে দালানের গা ধরে এগিয়ে চললো। এক সময় একটি দরজাও পেয়ে গেল। জেলে দরজা খোলার জন্য চেষ্টা করলো। অনেক চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হল। সে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কি করবো? হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। দরজা খোলার পর সে দালানের মধ্যে প্রবেশ করলো। আর অমনি দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। জেলে এগিয়ে চললো। সে দেখতে পেলো দালানের মধ্যে কোন পানি নেই। দালানের কামরা গুলোতে দিনের মত আলোকময় বলে মনে হলো। দালানের মধ্যে পানি প্রবেশ করতে পারছে না।
জেলে দালানের কয়েকটি কামরা ঘোরা ঘুরি করে কিছুই দেখতে পেলো না। কামরাগুলোতে কিছুই নেই। এক সময় জেলে ঘুরতে ঘুরতে অপর একটির কামরার দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে একটা বিকট শব্দ হয়ে দরজা খুলে গেলো আর তার সামনে এসে দাড়ালো এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা। সেই কন্যা জেলেকে ডেকে নিয়ে গেলো তার কক্ষের মধ্যে।তার পর জিজ্ঞেস করলো “কি জন্য এখানে এসেছিস। তোকে আর ফিরে যেতে দেবো না। এখানে তোর চিরকাল থাকতে হবে। ” একথা বলে সে দরজা বন্ধ করে দিলো।
অনেক সময় পার হয়ে গেলো। জেলে বসে কান্না শুরু করলো। এমন সময় আবার সেই অপূর্ব কন্যা জেলের কাছে এসে দাঁড়ালো। তার পরিচয় দিলো। সে একজন পরী। জেলে ফিরে আসার জন্য তার পা জড়িয়ে ধরতে গেলে হঠাৎ সে উধাও হয়ে গেলো। জেলে মহা চিন্তায় পড়লো। আবার সে কান্না শুরু করলো।
আবার এসে পরী দাঁড়ালো তার সমনে। আর বলতে লাগলো- “তোর ঘরে স্ত্রী আছে আর আছে ছোট ছেলে মেয়ে তাই তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে তোর আর সারা দিন পরিশ্রম করে মাছ ধরতে হবে না। প্রতিদিন সূর্য উঠার আগে এখানে এসে জাল ফেললে এক সাথে অনেক মাছ পাবি। তবে এ কথা কাউকে বললে তোর বিপদ হবে।
জেলে তার শর্ত মেনে নিয়ে নৌকাসহ পানির উপরে ভেসে উঠলো। পরীর কথা মত প্রতিদিন সেখানে জাল ফেলে সে প্রচুর মাছ ধরতে লাগলো। কিছু দিনের মধ্যে সে অনেক টাকা পয়সার মালিক হয়ে গেলো। একদিন কথা প্রসঙ্গে তার স্ত্রীর কাছে পরীর কথা বলে ফেলে। পরের দিন ভরে মাছ ধরতে গিয়ে জেলে নৌকাসহ ডুবে গেলো আর ভেসে উঠলো না।
অনেকের ধারণা, পরীর এই দালানটি এখনো নাকি অক্ষত অবস্থায় পানির নিচে মাটির মধ্যে পুতে রয়েছে। প্রতি বছরে বর্ষাকালে মধুমতি নদীর কালীতলার বাকে প্রচন্ড ভারে পানিতে ঘুর্নিপাক হয়। আর এই ঘুর্নি পাকের মধ্যে পড়ে অনেক নৌকা ডুবে যায়। লোক মুখে শোনা যায় একবার এক দরবেশ কালীতলা গিয়ে নৌকায় পার হবার সময় ভীষণ তুফানের কবলে পড়েন। তিনি পার হয়ে গেলেন অতিকষ্টে। আর স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করে গেলেন। কালীতলা সোজা পার না হবার জন্য। অনেক কাল ধরে অজানা মাঝি ছাড়া কেউ কালীতলা সোজা নৌকা নিয়ে পার হতো না।
দরবেশ নদী পার হয়ে দক্ষিণ দিকে মধুমতির পার দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। নদীর পানির কাছে এসে দাঁড়ালেন। পানিতে ফুঁক দিলেন। তারপর চলে গেলেন। দরবেশ যেখানে দাঁড়িয়ে পানিতে ফুঁক দিয়ে ছিলেন, সেখান থেকে প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত নদীতে আর প্রচন্ড তুফান হতো না। মাঝি মাল্লা নৌকা নিয়ে কালীতলা সোজা পার না হয়ে তুফান না হওয়া জায়গা দিয়ে পার হতো। কালীতলার সামান্য দূরে শিরগ্রামের বাঁকে আজও খুব বেশি তুফান হয় না।
মধুমতির রূপ অনেক পালটে গেছে। গ্রীষ্মকালে মধুমতির বিশাল এলাকা নিয়ে চর জেগে উঠেছে। অনেক জায়গা দিয়ে সামান্য পানি থাকে। যার ফলে কোন কোন জায়গা দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। ফলে কালীতলার কাছে নদীর পানির ঘুর্ণিপাকের ভয়াবহতা অনেক কমে গেছে। গ্রীষ্মকালে এ ঘুর্ণিপাক তেমন একটা দেখা যায় না। তবে বর্ষাকালে এ ঘূর্ণিপাক দেখা গেলেও তেমন ভয়াবহ বলে মনে হয় না। আজও মানুষ বর্ষাকালে কালীতলা সোজা নৌকায় পার হতে ভয় পায়।