মহসিন মোল্যা, বিশেষ প্রতিবেদক-
নারিকেলের আচা আর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হুক্কা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৬৫ বছর বয়স্ক সত্তার বিশ্বাস। তিনি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল খানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে তিনি ৫০ বছর ধরে সংগ্রাম করে চলছেন। তিনি বাপ-দাদার পেশাকে আকড়ে ধরে আছেন। বাপ-দাদার এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় তাকে। এমনকি অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার কারণে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়। তার এ কাজে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সহযোগিতা করে থাকেন৷ বসতবাড়ির মাত্র ৫ শতক জমি ছাড়া চাষাবাদের কোন জমিজমা নেই। হুক্কা বিক্রির টাকায় ১০ জনের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। অতীতে হুক্কার যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও বর্তমানে হুক্কার চাহিদা নেই বললেই চলে। কালের বিবর্তনে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অতীত এই ঐতিহ্য। বর্তমানে ধূমপানের মাধ্যম নামী-দামী সিগারেটের সাথে পাল্লায় টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার গ্রাম বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য ধূমপানের একমাত্র মাধ্যম হুক্কা। আগের আমলে জমিদারেরা পিতলের হুক্কা ব্যবহার করত।
আশির দশকে জনপ্রিয় ধুমপানের মাধ্যম ছিল এ হুক্কা। প্রতিটা ঘরে ঘরে ধুমপানের একমাত্র মাধ্যম ছিল এটি। শহর ব্যতিত সে সময় বিড়ি-সিগারেটের ব্যবহার ছিল না। গ্রামের কৃষক যখন মাঠে কৃষিকাজে যেত তখন সাথে নিয়ে যেত হুক্কা। বাঁশের চুঙ্গার ভিতর থাকতো তামাক, টিক্কা, পুরাতন রশি ও নারকেলের আঁশ ও খড় দিয়ে তৈরী বেনী।
এক সময় কৃষক-শ্রমিক এমনকি সাধারণ মানুষের বাড়ির ওঠানে সকাল-বিকালে কাজের ফাঁকে আয়েসী ভঙ্গিতে এক ছিলিম তামাকের সাথে নারিকেলের আশে আগুন ধরিয়ে তা ছিলিমে দিয়ে মনের সুখে হুক্কা টানত। এতে কৃষক-শ্রমিকের ক্লান্তি কেটে পরিতৃপ্ত পেত। জমিদার ও গ্রামের মোড়লরা নানাভাবে তামাক তৈরি করে হুক্কায় টান দিয়ে পরম আনন্দে তৃপ্তির স্বাদ নিত। গ্রাম-গঞ্জে সন্ধ্যা হলে বাড়ির উঠানে বসতো মুরব্বিদের গল্পের আসর। গল্পগুজব এর মধ্যে চলত হুক্কা দিয়ে ধূমপান। পরিবারের ছোটদের সকালের প্রথম কাজ ছিল দাদা ও মুরব্বিদের হুক্কা সাজিয়ে দেওয়া। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই হুক্কা কি তারা চিনে না।

শনিবার সকালে শ্রীপুর উপজেলা শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে হুক্কা বিক্রির সময় কথা হয় সত্তার বিশ্বাসের সাথে। এ সময় তিনি বলেন, এটা আমার বাপ-দাদার পেশা। এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে আমাকে এখনো অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। হুক্কার মুল উপকরণ নারকেলের আচা আর কাঠ। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেরও নারকেলের সংকট থাকার কারণে হুক্কা তৈরি করতে সংকট দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে ১’শ নারকেলের দাম ৭ হাজার টাকা। পূর্বে আমরা ১শ’ নারকেল ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় কিনতাম। কিন্তু বর্তমানে নারকেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় হুক্কা তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছে। নারকেল আমি বিভিন্ন গ্রামের গিয়ে সংগ্রহ করি। নারকেলে সংগ্রহের পর নারকেল ভেঙে আচা বের করা হয় তারপর আচাটি ভালো করে চেচে তা রোদে শুকাতে হয়। হুক্কার মাথার যে কাঠের নৈচে লাগানো হয় সেটা ২০ টাকা করে প্রতি পিচ কিনতে হয় । হুক্কা তৈরিতে প্রথমে আচার সাহায্যে মাটির কোলকে তার মাথায় মাটির নৈচে লাগানো হয়। এভাবে তৈরি হয় হুক্কা। প্রথমে হুক্কার ভিতর পানি দিতে হয়। তারপর কোলকের মধ্যে খেজুরের ঝোল গুড় দিয়ে তামাক তৈরি হয়। তারপর হুক্কা আস্তে আস্তে মুখ দিয়ে টেনে খেতে হয়।
তিনি আরো জানান, প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টি হুক্কো তৈরি করতে পারি। এ হুক্কা মাগুরা নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার লালনের আখড়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ির মহাজনদের কাছে বিক্রি করি। ১’শ পিচ হুক্কা পাইকারি বিক্রি হয় ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। প্রতি পিচ হুক্কা ২শ’ টাকা থেকে ২’শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে আমি এ হুক্কা বিক্রি করেছি ১ টাকা, দেড় টাকায়। আর ৮০ সালের পর ৫ টাকায়। ১৯৯০ সালের পর তা বেড়ে ২৫ টাকা ৩০ টাকায়। ২০০০ সালে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় ও বর্তমানে ২’শ টাকা থেকে ২’শ ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক পুঁজির প্রয়োজন কিন্তু আমার কোন পুঁজি নেই। ফলে প্রাচীন এ শিল্পটি যদি হারিয়ে যায় তাহলে আমাদেরও অনেক কিছু হারিয়ে যাবে। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান আমাদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এ প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে জোর দাবি রাখছি।
স্থানীয় নাকোল গ্রামের ইকবাল খান জানান, সত্তার চাচা হুক্কার সাথে প্রায় ৫০ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন। বর্তমানে এ শিল্প এখন হারিয়ে যাচ্ছে। জেলায় এ পেশার সাথে খুবই কম লোক জড়িত। সারাদেশে হাতে গোনা অল্পসংখ্যক শ্রমিকই এ পেশার সাথে জড়িত। তাই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, সত্তার ভাই দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সাথে জড়িত। এ পেশায় বর্তমানে তেমন মানুষ দেখা যায় না। তার সংসারে নানা অভাব অনাটন। বৃদ্ধ মা ও তার সন্তানদের নিয়ে তার সংসার। হুক্কা শিল্পটি অতি প্রাচীন। আগে রাজা-বাদশাসহ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল এ হুক্কো। তার শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য যথাযথ কতৃপক্ষকে এগিয়ে আসা খুবই জরুরি।
উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়নের শ্রীকোল গ্রামের কুবাদ মুসল্লী (৯০) তিনি হুক্কা দিয়ে ধূমপান করতেন। তিনি বলেন, আগে গ্রামের সবাই হুক্কা টানত। এর মধ্যে আলাদা একটা তৃপ্তি ছিল। এখন হুক্কা ছেড়ে বিড়ি, সিগারেট ও গাঁজা খায়। হুক্কার নেশায় যারা অভ্যস্ত তারা হুক্কা ছাড়া থাকতে পারবে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠে হুক্কার পানি বদলায়ে না খাইলে আমার পেট পরিষ্কার হতো না। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। হুক্কা, বিড়ি, সিগারেট কোন কিছুই আর এখন খাই না৷
শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, একটা সময় হুক্কার যথেষ্ট প্রচলন থাকলেও বর্তমানে হুক্কার ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে তার এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করা হবে।
Like this:
Like Loading...