শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব’-মহত্বে উদ্ভাসিত বরনীয় এই বাক্য দু’টি শিক্ষার মর্মার্থর পাশাপাশি বুঝিয়ে দিচ্ছে
নারী শিক্ষার গুরুত্বও। অথচ বাস্তবতা যে কত মর্মান্তিক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রায় শত বৎসর পূর্বে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন হৃদয় দিয়ে বিষয়টি উপলদ্ধি করেছিলেন। আর এটিকে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীকরে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর প্রায় সব লেখনীতে।
আমাদের সমাজে নারীর ভরণপোষণ পুরুষ বহন করে। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এটাকে স্বাভাবিক একটি বিষয় বলে আমরা মনে করি। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা একটি নারীর জীবনে ‘মানুষ’ পরিচয়ের ক্ষেত্রে কতটা অস্বাভাবিক ও ভয়ংকর তা বেগম রোকেয়া ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। এখানে পুরুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন – ‘…ফলতঃ তাঁহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন, তাহাতেই আমাদের সর্ব্বনাশ হইতেছে। আমাদিগকে তাঁহারা হৃদয় পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান-সূর্য্যালোক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিতা রাখিয়াছেন, তাহাতেই আমরা ক্রমশঃ মরিতেছি।’ সাধারনতঃ অর্থ আয়ের জন্য শিক্ষা তথা জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন হয় এই ভাবনা থেকেই নারী শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়না। কারণ নারীর জন্ম ঘরের ভিতর গৃহস্থালী কাজ করার জন্য, মূলতঃ এই লেখনীতে এটিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
দর্শনশক্তির বৃদ্ধি বা বিকাশ সম্বন্ধে একই প্রবন্ধে তিনি অন্য একটি যায়গায় লিখেছেন, ‘….“শিক্ষা”র অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের “অন্ধ-অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা।’ আর দর্শনশক্তির বৃদ্ধির ব্যাপারে নারী যে পুরুষের তুলনায় কতটা পিছিয়ে আছে তার উদাহরণ দিয়ে আক্ষেপ করে নারী জাতির প্রতি বলেন, ‘… দেখিলেন ভগিনী ! যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দ্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা মাণিক দেখে ! আমরা যে এহেন চক্ষুকে চির-অন্ধ করিয়া রাখি, এজন্য খোদার নিকট কি উত্তর দিব ? হ্যাঁ, ইসলাম ধর্মেও শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে নারী-পুরুষের ভেদ করা হয়নি। এ প্রেক্ষিতে তিনি জ্ঞানানুশীলনের প্রতি নারীদের জাগ্রত হতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করিনা বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব।’
যদি নারীকে স্বাধীনতা ও পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের যোগ্য হতে হবে। আর তা যেন তেন প্রকারে নয়, এজন্য অবশ্যই প্রয়োজন সুশিক্ষা। এই ভাবনা থেকেই তিনি বলেছেন, ….. কন্যাগুলিতে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।’
একটি কথা হরহামেশাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মুখে শোনা যায়, নারীদের কেন স্কুল কলেজে পড়ালেখা করতে হবে, রান্না করাই তাদের কাজ, এজন্যতো শিক্ষিত হবার প্রয়োজন নেই। প্রচলিত এই ধারণার অতি নিপুণ বিশ্লেষণ করেছেন ‘সুগৃহিনী প্রবন্ধে’। বাস্তবভিত্তিক অনেক উদাহরণ ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘…সুগৃহিনী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা আবশ্যক।’ পুরুষদের প্রতি আহ্বান করেছেন এভাবে – ‘যদি সুগৃহিনী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন।’ কেননা, খাদ্যের গুণমান ও রান্নার পদ্ধতির উপর দেহের পুষ্টি নির্ভরশীল, আর এ গুরুদায়িত্বটি আমাদের সমাজের নারীরাই পালন করেন। এছাড়া বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক সব্জী চাষ, গৃহপালিত পশুপাখীর পরিচর্যা, সন্তান প্রতিপালন, পরিবারের বয়স্ক ও অসুস্থ্য সদস্যদের সেবা এসব আমাদের দেশে নারীর বিশেষ পবিত্র কর্তব্য। এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি এক্ষেত্রেও যথেষ্ট শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে সবাইকে নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব অনুধাবনের অনুরোধ করেছেন । তাই তিনি একই প্রবন্ধে এর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘… তবেই দেখা যায়, এক রন্ধন শিক্ষা করিতে যাইয়া, আমাদিগকে উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন ও উত্তাপ তত্ত্ব (Horticulture, Chemistry I Theory of heat) শিখিতে হয় !!
শিক্ষার সাথে যে পর্দার কোন বিরোধ নেই তা “বোরকা” প্রবন্ধে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এ ব্যাপারে সমালোচকদের কটাক্ষ করে প্রশ্ন রেখেছেন, ………..বলি উন্নতি জিনিষটা কি ? তাহাকি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে ?’ একই প্রবন্ধে অন্যত্র বলেছেন, ‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন ইহাতে তাঁহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাঁহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূর্ব্বেও বলিয়াছি যে “নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবেনা।” ………’
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই এটি বোধগম্য হয়েছে যে নারী শিক্ষা শুধু নারীর ব্যাক্তিগত প্রয়োজন বা বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি পরিবার তথা সমগ্র সমাজের সব প্রশ্নের উর্ধে একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। যা শুধু নারীর কল্যাণ নয়, পুরুষের কল্যাণও বয়ে নিয়ে আসে পুরোপুরি।
বহু যুগের সীমানা পেড়িয়ে নিজেদের দিকে যদি তাকাই তাহলে কি দেখি – নারীর জন্য বেগম রোকেয়ার এই কান্না আজও কি থেমেছে ? আমরা কি পেরেছি নারীকে শিক্ষার সেই কাঙ্খিত অবস্থানে নিয়ে যেতে ? নারী আজ অনেক এগিয়েছে বলে অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু এই এগোনো কি সময়ের পরিক্রমায় যথেষ্ট ? অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেন ‘ধীরে ধীরে’ হবে। নারী বলেই কি ‘ধীরগতি’ ? কিন্তু এই ‘ধীরগতি’ পরিমাপের এককটাই বা কি ?
অন্যদিকে আমরা কি কখনও হিসেব কষে দেখেছি বিয়ের পর কত নারীর উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় ? ছেড়ে দিতে হয় কত নারীকে বহু সংগ্রামের বিনিময়ে পাওয়া তার পরম পেশাটি ? আর সন্তান জন্ম দেবার পর তার মাত্রা যে কতটা বেড়ে যায়, বুঝেছি কি তা বিবেচনা দিয়ে ?
শত বছর পর আজও নারী শিক্ষার প্রতি বেগম রোকেয়ার আকুতি বেজে চলেছে হাজার হাজার নারীর হৃদয়ে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। নারী শিক্ষা নানা সামাজিক বেড়াজালে আবদ্ধ। ইভটিজিং কেড়ে নিচ্ছে কত মেয়ের শিক্ষার অধিকার ! কেড়ে নিচ্ছে জীবন ! নারী শিক্ষার যাত্রাকে আজও কন্টকমুক্ত করা যায়নি। উপবৃত্তি ও নির্দিষ্ট ক্লাস পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষাকে অবৈতনিক করেই নারী শিক্ষাকে কাঙ্খিত মাত্রায় পোঁছানো যায়নি। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান অত্যন্ত দুঃখজনক। উচ্চ শিক্ষায় নারীকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে সমাজ বিশ্লেষণ করা। যেসব কারণে নারী শিক্ষা ব্যহত হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে। সমাজের কর্ণধারদের কাজ করতে এসব কারণ নির্মূলে এবং দলমত নির্বিশেষে আপোষহীনভাবে। তবেই এগিয়ে যাবে নারী তথা দেশ। আর এরই পথ ধরে পূরণ হবে বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন।

