মাগুরায় শীতের কুমড়ো-বড়িতে নারীদের ভাগ্য বদল

মাগুরানিউজ.কমঃ

নারীরা কুমড়ো বড়ি রোদে দিয়ে শুকাচ্ছেন
নারীরা কুমড়ো বড়ি রোদে দিয়ে শুকাচ্ছেন

ডালের কুমড়ো বড়ি বানানোর সময় এখন। শীতের শুরুতেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই সুস্বাদু তরকারি শীত এলেই বানানো শুরু হয়। তবে অনেক এলাকায় এটা বাণিজ্যিকভাবে খুবই জনপ্রিয়। যেমন মাগুরা সদরের বাটিকাডাঙ্গা গ্রামের কুমড়ো বড়ি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই বড়ি চলে যায় ঢাকাসহ উত্তরের জেলাগুলোতেও। সে গল্পটাই এখানে তুলে ধরা হলো।

শান্তি রানী দাস (৪২)। ডাল ভিজিয়ে পাটায় মিহি করে বেটে বেসন বানান। রাত ভোর হয়ে যায় তার এটা করতে। রাত পোহালে কুমড়ো বড়ি বানিয়ে কড়া রোদে শুকোতে দেন। তারপর বড়ি শুকালে শান্তির স্বামী শম্ভুনাথ দাস (৫০) বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। প্রতিদিন ১০-১৫ কেজি বড়ি বিক্রি হয়। কঠোর শ্রমের এই কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে তারা এখন অনেকটা স্বাবলম্বী। সংসারে অভাব নেই। এটা করেই তার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেয়ে এখন স্নাতক পাশ করেছে। আগে সরকারি খাসজমিতে বাড়ি করে বসবাস ছিল। এখন নিজের কেনা জমিতে দুটি টিনের ঘর তুলে বাড়ি করেছেন শম্ভুনাথ।

download                                              মনোরম কুমড়ো বড়ি রোদে শুকানো হচ্ছে

মাগুরা সদরের বাটিকাডাঙ্গা গ্রামে বহুদিন থেকেই এলাকবাসীর কাছে কুমড়ো বড়ির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামেই শান্তি রানীর বসবাস। তার মতোই এ গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। বছরের সাত মাসের এ ব্যবসায় এখন পরিবার গুলোর চালচিত্র বদলে গেছে। প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ছে। এক সময়ে ভূমিহীন অনেক পরিবার জমি কিনে নতুন টিনের ঘর তুলে বাড়ি করেছে। মানুষগুলো স্বচ্ছলতার আলো এনেছে পরিবারে।

পৌরসভার ভেতরে গ্রামটিতে এই হেমন্তের এক সকালে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় এ ব্যতিক্রমী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষদের সঙ্গে। দেখা যায়, সবাই কুমড়ো বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে বাড়ির আঙ্গিনায় রোদে শুকাতে দিয়েছেন। কথা হয় বৃদ্ধা মনোরমা পালের সঙ্গে। বলেন, ‘আমার মাকে বড়ি বানিয়ে বেচতে দেখেছি আমি। তখন চার আনা সের খেশারি ডাল ছিল। বড়ি বিক্রি হতো বার আনা সের।’

তিনি বলেন, এই বড়ি বেচে আমি তিন ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি। দুই মেয়েকে আইএ পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তিন ছেলে এখন মিষ্টির ব্যবসা করে।

প্রদীপ ভৌমিক বলেন, ‘এক কেজি বড়ি বানাতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩৪ টাকা। পাইকারী বিক্রি হয় ৪৫-৫০ টাকা কেজি। খুচরা বিক্রি হয় হাটে-বাজারে ৬০ টাকা। তিনি বলেন,  আমরা খুচরাই বেশি বিক্রি করি। তাতে লাভ বেশি থাকে।’
       download (1)                                         ঘরের চালে কুমড়ো বড়ি শুকানো হচ্ছে

মনোরমা পালের নাতনী কলেজ ছাত্রী সরস্বতী রানী পাল জানান, এই কুমড়ো বড়ি বানানো, শুকানো সহ সব কাজ মেয়েরাই করে। আর ডাল পাটায় বেটে বেসন না করলে এ বড়ি হয় না। মেশিনে এ বড়ি হয় না।

আদরী রানী ভৌমিক (৩০)বলেন, বড় মেয়েকে আইএ পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এই বড়ির ব্যবসা করেই জমি কিনে সেখানে আধাপাকা দুটি ঘর করেছি। বাবার বাড়িতেও জমি কিনেছি। বিজলী রানী (৩২) বলেন, ইডা ছোট ব্যবসা হলিও লাভ অনেক। তবে পরিশ্রম বেশি। আমরা ইডা করে উন্নতি করতিছি। ভালই চলে। মাছ-ভাত খাই। তার দুই ছেলে উৎপল নবম শ্রেণিতে ও সুফল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। সুফল জানায়, ছুটির দিনে সে পাশের বাজারে বড়ি বিক্রি করতে নিয়ে যায়। সোনা ভৌমিক (৪৫) বলেন, এই গ্রামের যোগেন ঘোষের বউ প্রথম কুমড়ো বড়ি বানান। সে অনেক বছর আগের কথা। তিনি বিক্রি করতেন না। আমার বড়মা বীনাপানি (৭৫) স্বামীর মৃত্যুর পরে এই বড়ি বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন প্রথম। ৪০ বছর তিনি বড়ি বানিয়েছেন।

বেলা রানী ভৌমিক (৪৫) বলেন,  এখানে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে ২৫ বছর বড়ি বানাচ্ছি। এটাই আমাদের জীবিকা। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। এক মেয়েকে এইচএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আরেকটা শিপ্রা রানী এইচএসসি পাশ করে কম্পিউটার শিখছে। এক ছেলে সোনার কাজ করে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বেলা রানী বলেন, আগে দেবরের বাড়িতে থাকতেম। তিন বছর হলো জমি কিনে বাড়ি করিছি। দুটে টিনের ঘর দিছি।

নিখিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘১৮ বছর কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করতিছি। দুইভাই মিলে দিনে ১০০ কেজি বড়ি বানিয়ে বিক্রি করি।  সাত বছর ভাড়া বাড়িতে বাস করিছি। অল্পদিন হয় জমি কিনে টিনের ঘর দিছি।’

শম্ভুনাথ দাস (৫০) বলেন, ‘আগে সব ডালের বড়ি বানানো হতো। ডালের দাম বেশি হওয়ায় এখন শুধু এ্যাংকর ডালের বড়ি বানানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘এটা সাত মাসের ব্যবসা। বাংলা ভাদ্র থেকে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাসে গিয়ে শেষ হয়। বাকি সময় আমরা অন্য কাজও করি।’

মনোরমা পাল বলেন, ডাল চার ঘণ্টা পরিস্কার করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাটায় ভোরে বাটতে হয়। হাত দিয়ে ফেনানোর পর কালজিরা, সাদা জিরা ও গুয়ামহুরি দিয়ে সকালে বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে রোদে শুকাতে হয়। সোনা ভৌমিক বলেন, আবহাওয়া খারাপ হলি বড়ি শুকানা যায় না। তখন ডাল গরু দিয়ে খাওয়াতে হয়। প্রায় দুইদিন লাগে বড়ি শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করতে।

এ গ্রামের বাসিন্দা মোহন সরকার বলেন, তরকারি হিসেবে কুমড়ো বড়ির তুলনা নেই। এক সময় বউ-ঝিরা বাড়িতে শখ করে বড়ি বানাতেন। আর এখন এটা এ গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারের প্রধান জীবিকা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

September ২০২৩
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
« Aug    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০  

ফেসবুকে আমরা

বিভাগ

দিনপঞ্জিকা

September ২০২৩
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
« Aug    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০  
%d bloggers like this: