বিধ্বস্ত ভবনের ইট-পাথর পড়ে আছে রাস্তায়। এরই মধ্যে মোবাইল ফোন কানে হেঁটে যাচ্ছেন এক নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি তরুণ। চেহারায় উদ্বেগ আর আতঙ্কের ছাপ নিয়ে কিছু খুঁজছেন তিনি। সামনে ইসরাইলি বাহিনী। জানালেন, স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি গুলির শব্দ। আহত হয়ে ভাঙা ভবনের ধ্বংসস্তূপে পড়ে গেলেন ওই ফিলিস্তিনি। কিন্তু তাকে তো মা আর ছোট বোনটিকে খুঁজে বের করতে হবে। ইসরাইলের হামলায় পলাতক সারি সারি ফিলিস্তিনির মধ্যে রয়েছে তারাও। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু আরেকটি ইসরাইলি বুলেটে অন্ধকার হয়ে গেল তার সারা পৃথিবী। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইনের সুবাদে বিশ্ববাসী ইসরাইলি বর্বরতার এই চিত্রটি দেখেছে। কিন্তু শত শত ফিলিস্তিনি রাতের অাঁধারে ভবনের ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে যেভাবে মরছেন_ সেসব দৃশ্যের অনেকটুকুই এখনও অন্তরালে। মায়ের প্রাণহীন নিঃসাড় দেহ পাশে নিয়ে শিশুর কান্না হয়তো দেখেনি বিশ্ব। ইসরাইলি বর্বরতার চতুর্দশ দিনে মঙ্গলবার নিহতের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়েছে।
একদিকে কান্নার রোল, অন্যদিকে নৃশংস এই হত্যাকা- চালিয়ে বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে ইসরাইল। গাজা সীমান্তের কাছে একটি পাহাড়ে উঠে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখছে। চিপস আর কোমল পানীয় নিয়ে ভূমধ্য সাগরের তীরে দাঁড়ানো ওই পাহাড়ে বসে পিঁপড়ার মতো পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের কান্নার রোল শুনে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, সেখানে বসার জন্য সোফা ও অন্যান্য সুব্যবস্থাও রয়েছে তাদের জন্য। ফিলিস্তিনিদের রক্তে ভূমধ্য সাগরের পানি রঞ্জিত হলেও হামলা আরও তীব্র করছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে গাজার একের পর এক শহর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। বোমাবর্ষণ চলছে সমান তালে।
ফিলিস্তিনি শিশুদের তাজা রক্ত জ্বালানি করে ইসরাইলি ট্যাঙ্কের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সমাধান দিতে পারেনি জাতিসংঘ। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বেসামরিক মানুষ হত্যার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বলছেন, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। নিহত হয়েছেন ইসরাইলের ২৭ সেনাও। এক সেনা নিখোঁজ রয়েছে বলেও দাবি করেছে ইসরাইল। অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার উত্তরাঞ্চলের শহর শাহজিয়া। ওই শহর ও আশপাশের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। তাদের অনেকের শরীরেই ইসরাইলি আঘাতের ক্ষত। হাসপাতালে অপেক্ষাকৃত কম আহতদের জায়গা হচ্ছে না; গুরুতর আহতরাও এখন পর্যাপ্ত ওষুধের অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এর মধ্যে কয়েকটি হাসপাতালেও হামলা চালিয়ে লোকজন হত্যা করা হয়েছে। স্থল, বিমান ও নৌপথে চালানো হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মসজিদ এবং স্কুলও।
অদ্ভুত পরিস্থিতিতে খানিকটা টনক নড়েছে জাতিসংঘের। কীভাবে এই হত্যাযজ্ঞ থামানো যায়_ এ নিয়ে সংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুন মিসরের কায়রোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে আলাপ করবেন। এরই মধ্যে কেরি বলেছেন, ইসরাইলের হামলা ন্যায্য ও আইনসঙ্গত। কায়রোতে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেরি। এর আগে মিসরের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ সিসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন বান কি মুন। সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ইসরাইল ও হামাস_ দুই পক্ষই এখনও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এরই মধ্যে পাঁচ ঘণ্টার একটি মানবিক যুদ্ধবিরতিও অগ্রাহ্য করেছে ইসরাইল। হামাস বলছে, তিন পাশে ঘিরে রাখা ইসরাইল ও একপাশের মিসরকে অবশ্যই গাজার ওপর অবরোধ তুলে নিতে হবে। হামাসের দাবি, ‘নীরব ঘাতক’ এই অবরোধে না খেয়ে মরছে তাদের লোকজন। এত প্রাণের বিনিময়ে তাই কেবল একটি যুদ্ধবিরতিতে যেতে আগ্রহ তাদের নেই। ফিলিস্তিন মনে করে, কেবল যুদ্ধবিরতি এই সমস্যার সমাধান নাও দিতে পারে; আবারও হামলা শুরু করতে পারে ইসরাইল।
আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, গাজায় ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ৬০৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭০০। নিহতের অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশু। হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় মঙ্গলবার চার নারীসহ এক পরিবারের সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে সোমবার এক পরিবারের ২৫ সদস্য নিহত হন। কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই তাদের ওপর এই হামলা চালানো হয়। এদের মধ্যে চার নারী ও ১৮ শিশু রয়েছে। এদের তিনজন ছিলেন ছিলেন গর্ভবতী। আতঙ্কের জনপদ ছেড়ে এখন দিগ্বিদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।
গাজায় বর্বর হত্যাকা- বন্ধ করতে ইসরাইলের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা ফবিয়াস দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে তিন দিনের শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুরস্ক। মঙ্গলবার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এটা ভুলবেন না, যদি আমরা চুপ থাকি তাহলে কেবল গাজার ক্ষতি হবে না, এটা তুরস্কের স্বাধীনতার জন্যও এক বড় আঘাত। জানা গেছে, গাজায় আল-জাজিরার ব্যুরো অফিসেও হামলা হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ঘনবসতিপূর্ণ গাজার বেসামরিক মানুষ এখন আশ্রয়ের কোনো স্থান পাচ্ছেন না। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের মুখপাত্র জেনস লার্কি বলেন, বেসামরিক মানুষের জন্য (গাজায়) কার্যত কোনো নিরাপদ স্থান নেই।
আল-জাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২১ শিশুও রয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে আরও ৯০০ শিশু। গাজার মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১২ লাখ খাবার ও পানীয়ের ভয়াবহ সঙ্কটে রয়েছেন। মঙ্গলবার ইসরাইলের প্রধান শহর তেলআবিবে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হামাসকে দোষ দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। গাজা থেকে হামাসের রকেট হামলার নিন্দা জানান তিনি। তবে দুই পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সহনশীলতা’ দেখানোরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।