চলছে বিশ্বকাপের মৌসুম, পৃথিবীর আর সব ফুটবলপ্রেমী দেশের মতন বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে এই উন্মাদনার জোয়ার, কারো গাড়ি প্রিয় দলের পতাকায় মোড়া, তো কারো আস্ত বাড়িটাই। কেউ আবার শুধুমাত্র নিজ মুখে রঙ ছড়িয়েই শান্ত হননি, রঙের আঁচড় ছড়িয়ে দিয়েছেন, নিজের বাড়ির দেয়ালে, পাশের বাড়ির উঠোনে। এই আমেজ পারিপার্শ্বিক সবকিছুকে ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে যার যার ফেসবুকেও। এখন প্রায় সবার ফেসবুক প্রোফাইল ফটোই নানা রঙের বর্ণিল পতাকায় মোড়া। ব্যতিক্রম শুধু একদল ছেলে মেয়ে, একদল ঘুমপালানো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের দল তাদের নিজ নিজ প্রোফাইল রাঙিয়ে দিয়েছে “আম”-এর রঙে। তাদের প্রোফাইল ফটোতে আম উৎসবের ছবি, তাদের কাভার ফটোতে আমের ছড়াছড়ি। কারণ একটাই, বছর ঘুরে আবার এসেছে “পথশিশুদের আম উৎসব”। ফেসবুকের নীল দেয়ালে ২০১০ সালে যে বন্দি উৎসবটির জন্ম হয়েছিলো, চার বছর পেরিয়ে ইট-কাঠ আর দালানকোঠা ছাড়িয়ে সেই উৎসবের সীমানা এবার যায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগে। পঞ্চমবারের মতন এই উৎসবটি আগামী ২১শে জুন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকার পাশাপাশি, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং বরিশাল বিভাগেও। ২০০৯ সালে জন্ম নেয়া “আমরা খাঁটি গরীব…” নামে ফেসবুকের একটি গ্রুপ থেকে প্রতিবছর সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল পথশিশুদের জন্য আম উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রথমবার শুধুমাত্র ঢাকায় আম উৎসব করা হলেও বছর বছর বাড়ছে এর পরিধি।
প্রতিবছরের জুন আসের শেষ শনিবার আয়োজন করা হয় এই আম উৎসবের, এবারে পবিত্র রমজান মাস চলে আসার কারণে উৎসবের তারিখ এক সপ্তাহ এগিয়ে ২১শে জুন ঠিক করা হয়েছে। পুরো জুন মাস জুড়ে প্রস্তুতি থাকে এই উৎসব আয়োজনের। যেসব পথশিশুরা দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পারে না, তাদের কাছে ফলের রাজা আম খাওয়াটা স্বপ্নের মতন। তাদেরকেই একদিনের জন্য আনন্দ দেয়ার জন্য, তাদের মুখটা আমের রসে মাখিয়ে দেবার জন্যি প্রতি বছর আয়োজন করা হয় এই আম উৎসবের।
প্রশ্ন আসতে পারে এই আম উৎসব আয়োজনের জন্য অর্থ আসে কিভাবে? উত্তরটা খুব মজার। “আমরা খাঁটি গরীব…” গ্রুপের ছেলেমেয়েরা কেউ নিজের পকেট খরচ বাঁচিয়ে, কেউ বিকেলের নাস্তায় ২টা পুরি, সিঙ্গাড়া কম খেয়ে, কেউ বা আবার প্রিয়জনের সাথে মোবাইলে একদিন একটু কথা কম বলে, রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে হেঁটে তিল তিল করে সারা মাস ব্যাপী জমায় এই উৎসবের জন প্রয়োজনীয় অর্থ। কেউবা বিকেলের আড্ডায় বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সাহয্য নিয়ে জমা করে দেয় “গরীবের একাউন্টে”। এভাবে বিন্দু বিন্দু করে জমানো টাকা জমতে থাকে আম উৎসবের ফান্ডে। আর এই গ্রুপের ভনাল্টিয়ারদের চোখে মুখে বড় হতে থাকে স্বপ্নের পরিধি, অসহায় সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মুখে হাসি দেখার স্বপ্ন। এ বছর এই আম উৎসবের ফান্ড রেইজিং-এ যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। চট্টগ্রামের ছেলে-মেয়েরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গিয়ে বন্ধুদের কাছে আম উৎসবের গল্প বলছে, বিনিময়ে পাচ্ছে কিছু সাহায্য, রংপুরের ছেলে-মেয়েরা রাস্তায়, ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছে লালরঙা তাজা গোলাপ, ঢাকার না ঘুমানোর দলেরা রাত জেগে কাগজ দিয়ে তৈরি করছে মুখোশ, ব্যান্ডানা, হাতপাখা, ফুল সহ নানান জিনিসপত্র, সেগুলো বিক্রি করে বেড়াচ্ছে স্কুল থেকে স্কুলে, সিলেটের ভলান্টিয়াররা আয়োজন করছে নানান ইভেন্টের। আর এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ইতালীতে অবস্থিত এই গ্রুপেরই সদস্যরা। তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে রোম-এ আয়োজন করে ফেলেছিলেন এক ব্যতিক্রমী উৎসবের। সেই ইভেন্টে আগত সবাইকে বিনে পয়সায় তাঁরা বাংলাদেশী পিঠা খাইয়েছেন, সেই পিঠা খেয়ে তাঁরা আম উৎসবের জন্য অর্থসাহায্য করেছেন, সুদুর আমেরিকা থেকে এক বোন খুব প্রিয় একটা শাড়ী কেনার টাকা পুরোটাই দিয়ে দিয়েছেন গরীবের তহবিলে, দুবাই-এর এক বন্ধু এই আম উৎসবের চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো বাঙ্গালী কমিউনিটিতে — এভাবেই জমছে আম উৎসবের গল্প।
এই গল্পগুলোকে সাথে নিয়েই “আমরা খাঁটি গরীব…” গ্রুপের ভলান্টিয়াররা আগামী ২১ জুন ছুটবেন আবার পথশিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা পথশিশুদের স্কুলে স্কুলে গিয়ে তাদেরকে দুইটি করে আম খাওয়ানো হবে এদিন। এবার আমের পাশাপাশি তাদেরকে কিছু খেলাধুলা সরঞ্জামও দেয়া হবে। হয়ত আবার দেখা হবে রায়েরবাজারের ছোট্ট টুনি’র সাথে, যে গতবছর আমের গায়ে ঠিক মতন কামড় বসাতে পারতোনা, ছোট্ট দুইটা হাতে বিশাল আমটা নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো সেদিন, হয়তো জীবনে এটাই ছিলো তার প্রথম আম খাওয়া, কিংবা দেখা মিলতে পারে কমলাপুরের টাক্কু মাথা সাজ্জাদের সাথে, যে ২০১২ সালে দুইটা আম হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ, আর তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছিলো আষাঢ়ের প্রথম বর্ষা। হয়তো দেখা পেয়ে যাবো চিন্দ্রিমা উদ্যানের শিরিন, কিংবা হাইকোর্ট এলাকার মোমেনার সাথে যারা আম দুইটি পাওয়া মাত্রই জামার কোনায় বেঁধে দৌড় দিয়েছিলো তার ছোট ভাইকে নিয়ে খাবে বলে। অথবা আবার দেখতে পাবো যাত্রাবাড়ীর অন্ধ কায়েস-এর বুক ভেঙ্গে দেয়া হাসিমুখটা। আম হাতে নিয়ে শুঁকতে শুঁকতে যখন সে আমের গন্ধ বুঝতে পারে তখন আর সব কোলাহল ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে তার নিশ্চুপ পাগলাটে হাসিটা। এই হাসিটাই গরীব গ্রুপের ভলান্টিয়ারদের একমাত্র পাওয়া। এই হাসিমুখ দেখার জন্যই সারা মাস ধরে তাদের এই পরিশ্রম। এই মুহূর্তগুলোই তাদের অর্জন, এর জন্যই তাদের প্রতি বছর বছর এভাবে কাজ করা। বার বার এখানে ফিরে আসা। যতদিন তাদের দেহে মনে সামর্থ্য থাকবে, ততদিন তারা অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে এভাবেই হাসি ফুটিয়ে যাবে।