
মাগুরানিউজ.কম: শিক্ষার আলো পাবে সব শিশু, বাদ যাবে না কোন শিশু। বিষয়টিকে সত্য হিসেবে তুলে ধরতে মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা হাতে নিয়েছে বড় প্রয়াস। পথশিশু ও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে টিফিনের টাকায় ‘সোনামনি পাঠশালা’ গড়ে তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
ভয় পাওয়ার মতো কোনো স্যার বা ম্যাডাম এখানে নেই তাই পাঠ দিচ্ছেন নিজেরাই। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কও এখানে বন্ধুর মতো।
ছোট্ট একটি ঘর, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কারণে তিল ধারণের ঠাঁই নেই কক্ষটিতে। অসহ্য গরম, তবুও গুনে-গুনে পাঁচ থেকে ১২ বছরের প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী মনযোগ দিয়ে লেখা-পড়া করছে রুমটিতে।
মিরসরাই পৌর-সদরের অছি মিয়ার ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে বস্তি এলাকায় ঢুকলে চোখে পড়ে পথশিশুদের জন্য ক্ষুদে শিক্ষকদের এই পাঠশালাটি। সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মিটিমিটি করে আশার আলো জ্বালাচ্ছে এই পাঠশালাটি। মূলত: যারা কোনদিন স্কুলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেনি তাদের নিয়ে এই স্কুলের কার্যক্রম।
পাঠশালাটির মূল উদ্যোক্তা ও মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহেদ হাসান শাকিল জানান, একদিন বিকেলে এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে ওই এলাকা দিয়ে ঘুরতে বের হলে বস্তি এলাকার শিশুদের হট্টোগোল আমার নজরে আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি এদের কেউই স্কুলে যায় না। তখন বুঝতে পারি, এভাবেই সুবিধা বঞ্চিত ও পথশিশুদের সমাজের মূল ধারাতে জায়গা না পেয়ে একসময় নানারকম অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। একসময় যার প্রভাব পড়ে এই সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশে।
পরে আমার সহপাঠী তুহিনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। গত ২০ মার্চ শিক্ষার আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে পাঠাশালাটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে আমাদের কোনো কক্ষ না থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেইনের জন্য নব নির্মিত ওসি মিয়ার ব্রিজের ওপর শিক্ষার্থীদের পাঠ দেয়া শুরু হয়। পরে ৯ম ও ১০ শ্রেণির বড় ভাইদের সহযোগিতায় টিফিনের টাকা জমিয়ে পার্শ্ববর্তী বস্তির ভেতর মাসিক ৭শ টাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়। বর্তমানে ওই কক্ষেই পাঠ দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
পাঠশালার অপর উদ্যোক্তা ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরমান হোসেন নিলয় জানায়, পথশিশুদের সহযোগিতায় নিজেদের সম্পৃক্ততার ইচ্ছে নিয়ে সমমনা বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে আলাপ শুরু হলে উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে একে একে তার সঙ্গে যোগ দেয় সাব্বির আহম্মদ শাকিল, আফনান হাসান ইমরান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, তানভীল জুবায়ের, টি এম পারভেজ, সবুজ, সময়, সুজন, রুজেল, রায়হান, রুদ্র, হান্নান, রিয়াদ, হাসান, হৃদয়সহ অনেক বন্ধুরা।
সম্প্রতি মারুফ মডেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জে বি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্ররাও এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছেন। পাঠশালাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গত ৩ মে প্রথমবারের মতো ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এ কমিটির সদস্য সংখ্যা ৪০ জন। টিফিনের টাকা থেকে যে যার ইচ্ছে মতো টাকা দিয়ে পাঠশালাকে টিকিয়ে রেখেছে।
আরমান হোসেন আরো জানান, প্রাথমিকভাবে পাঠশালার সব ধরনের ব্যয় সহপাঠীদের টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সমাজের কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা নেওয়া হয়নি। বড়দের কারো সঙ্গে কোন আলোচনাও হয়নি।
নিজেদের ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী পাঠশালাটির শিক্ষক তানভীর হোসেন তুহিন বলেন, নিজের দায় থেকে এ স্কুলের সঙ্গে আছি। প্রয়োজনীয় সময় থেকে বাঁচিয়ে এখানে শ্রম দিই। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার এতো আনন্দ আগে বুঝিনি। আশা করি আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে আমাদের পাঠশালার পথচলা।
সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে কথা হয় পথশিশুদের একজন সঞ্চিতা দাস। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। সে জানায়, তার বাবা গ্রামে গ্রামে আইসক্রিম বিক্রি করে। মা মানুষের বাসায় কাজ করে। তবে সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। সে জন্য এখানে লেখাপড়া করতে এসেছে। স্যারদের এই স্কুল খুব ভাল লাগে তার।
ঝালমুড়ি বিক্রেতার ছেলে রিফাত, রিকশা চালকের ছেলে সাগর, রিয়াজ, পিতৃহীন রহিমা পাঠশালায় খুব খুনসুটি করছিল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, আনন্দে ভাসছে তারা। কিন্তু এটা তো স্কুল। এখানে এমন হাসি হট্টগোল কেন? স্যাররা বকা দেয় না? জানতে চাইলে একগাল হাসি নিয়ে তারা বলে, ‘স্যাররা ভাল আছেন, বুঝছেন? মারে না !’
পাঠশালার সঙ্গে সম্পৃক্ত ক্ষুদে উদ্যোক্তা শিক্ষকদের স্বপ্ন সরকার ও গ্রামের সবার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাবে সোনামনি পাঠশালা। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেবে গ্রামের প্রতিটি ঘরে।
বিষয়টি জানাতে চাইলে মিরসরাই মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও মিরসরাই পৌর মেয়র এম শাহজাহান বলেন, বিষয়টি আমি জানিনা। তবে কচিকাচা শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। শীঘ্রই তিনি পাঠশালাটি পরিদর্শনে যাবেন ও প্রয়োজনীয় সর্বাত্মক সহযোগিতার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান।