বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশকে দিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এই রায়ের কথা প্রকাশ করে বলেন, “এই রায় উভয় রাষ্ট্রের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। এ বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। এ বিজয় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের বিজয়।”
বঙ্গোপসাগরের সীমা, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের তলদেশে সার্বভৌম অধিকার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের দাবির শুনানি শেষে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালত বা পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন (পিসিএ) সোমবার রায়ের অনুলিপি হস্তাতান্তর করে।
ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বিচারকের মধ্যে পেমারাজু শ্রীনিবাস রাও ভিন্নমত পোষণ করলেও রুডিগার ভোলফ্রাম, টমাস এ মেনশাহ এবং আইভান শিয়েরার জ্যঁ-পিয়ের কৎয়ের মতামত অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিরোধ মীমাংসা করেছে আদালত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ঊপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপান এলাকার প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
“ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল বিরোধপূর্ণ আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশকে দিয়েছে।”দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সদিচ্ছা দেখানোয় এবং ট্রাইব্যুনোলের রায় মেনে নেয়ার জন্য ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানান তিনি।
২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্য হেগের পিস প্যালেসে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলার মৌখিক শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন এজেন্ট দীপু মনি, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উত্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল।
সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধের প্রধান বিষয় ছিল দুই দেশের জলসীমা শুরুর স্থান নির্ধারণ। এছাড়া ভূমিরেখার মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রে রেখা টানার পদ্ধতি নিয়েও মতবিরোধ ছিল।
সমুদ্রসীমা বিরোধের ক্ষেত্রে ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে রেখা টানার পক্ষে মত দিলেও বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে রেখা টানার দাবি জানায়।
বাংলাদেশের দাবি ছিল, বঙ্গোপসাগর ও ভূমির মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রির সোজা রেখা যাবে। তবে ভারত বলে- সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি থেকে।
শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে কৌঁসুলী হিসেবে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পল রাইখলার ও লরেন্স মার্টিন, যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক জেমস ক্রাফোর্ড, ফিলিপ স্যান্ডস ও অ্যালান বয়েল এবং ক্যানাডার অধ্যাপক পায়াম আখাভান।
মামলায় বাংলাদেশের এজেন্ট ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “আজ আমাদের আনন্দের দিন। ন্যায্যতার জয় হয়েছে। সকল পক্ষের জয় হয়েছে। এটা উইন উইন সিচুয়েশন।আমাদের যা দরকার আমরা তা পেয়েছি। প্রতিবেশী দেশও তাদের যা পাওয়ার তা পেয়েছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেশী এ দুটি দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি হেগের আদালতে গড়ায়।
এর আগে ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের যে রায় দেয় তাতে নায্যতার ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত জলসীমা পায় বাংলাদেশ।