মাগুরানিউজ.কমঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাগুরার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দীর্ঘ ৯টি মাস পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যা, নির্যাতনের কালো অধ্যায় পেরিয়ে ১৯৭১-এর ৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় মাগুরা। আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবময় কাহিনী সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন, প্রবীন সাংবাদিক,আইনজীবি, মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক—দীপক রায় চৌধুরী ।
পাক বাহিনীর প্রবেশ: পাক বাহিনী ও মিলিশিয়ারা মাগুরায় আসে ৭১-এর মার্চের শেষদিকে। মাগুরায় প্রথম শহীদ হন শহরের এক পাগল। পাক বাহিনীকে দেখে সে জয় বাংলা বলে উঠলে হানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে। শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জগবন্ধু দত্তকে তার বাড়িতে গুলি করে মারে পাক বাহিনী। পাক বাহিনীর দোসর আলবদর আলসামস শহরের কালি মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে ও মূর্তি ভাংচুর করে। তারা জেলার বিভিন্ন বাজার, বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
হানাদারদের ঘাঁটিঃ মাগুরা শহরের পিটিআই, সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বালক বিদ্যালয়, আনসার ক্যাম্প, ডাকবাংলাতে পাক বাহিনী ঘাটি স্থাপন করে। শহরের গোল্ডেন ফার্মেসী ভবন, রেনুকা ভবন, জগবন্ধু দত্তের বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি দখল করে রাজাকার ও শান্তি কমিটি তাদের অফিস স্থাপন করে। এসব স্থানে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করতো। পিটিআই এর পিছনে পাক বাহিনী বিমান নামার অস্থায়ী রানওয়ে নির্মাণ করেছিল।
বধ্যভূমি ও গণকবরঃ মাগুরার ওয়াপদা ব্যারেজ, ক্যানেল, পিটিআইতে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। পিটিআইতে বহু মানুষকে হত্যা করে তারা মাটি চাপা দেয়। এসব গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি। আড়পাড়ায় ডাক বাংলোতে পাক বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ফটকি নদী দিয়ে নৌকাযোগে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে হত্যার পর ডাক বাংলোর প্রাঙ্গণে একটি ইদারায় ফেলে দিত। ছয় ঘরিয়ায় ১৩ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর, হাজরাহাটিতে ৭ মুক্তিযোদ্ধার এবং তালখড়িতে ৭ মুক্তিযোদ্ধার গণকবরগুলো অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। কেবল পিটিআই এর সামনে একটি স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়েছে।
পাক বাহিনীর নির্যাতনঃ পাক বাহিনী মাগুরায় যে বর্বর নির্যাতনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তার তুলনা পাওয়া ভার। হানাদাররা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা লুত্ফুর নাহার হেলেনাকে ধরে এনে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে। প্রগতিশীল এই নারীকে তারা জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা মাগুরা শহর টেনেহিঁচড়ে হত্যা করে। ২৬ নভেম্বর ভোরে কামান্না গ্রামে মাধব চন্দ্র কুণ্ডুর ঘরে ঘুমন্ত ২৭ মুক্তি যোদ্ধাকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এদের সকলের বাড়ি মাগুরার হাজীপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে। ছয় ঘরিয়ায় ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এবং হাজরাহাটি নামক স্থানে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকাররা নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে।
সম্মুখযুদ্ধঃ মাগুরায় পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ হয়। এগুলোর মধ্যে মহম্মদপুর উপজেলা সদরের যুদ্ধ, বিনোদপুর যুদ্ধ, জয়রামপুর যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে আহম্মদ, মোহম্মদ (দু’ভাই), আবীর হোসেন, মুকুলসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
আকবর বাহিনী: শ্রীপুর উপজেলার টুপি পাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন মিয়া গড়ে তোলেন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের দল ‘আকবর বাহিনী’। আকবর হোসেন ছিলেন এ দলের কমান্ডার আর বর্তমান জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোল্যা নবুওয়াত আলী তার ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। এই বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করে পাক বাহিনীকে।
শত্রুমুক্ত হলো মাগুরা: ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর পাক বাহিনী মাগুরায় এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে টিকতে না পেরে পাক সেনারা সেদিন বিকাল থেকেই মাগুরা ছেড়ে পালাতে শুরু করে। রাতে তারা গড়াই নদী পার হয়ে ফরিদপুরে কামারখালীর দিকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। মাগুরায় ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সর্বত্র জয় বাংলা ধ্বনীতে মুখরিত হয়ে উঠে। মিত্র বাহিনীর জেনারেল অরোরা হেলিকপ্টারযোগে মাগুরার নোমানী ময়দানে এসে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
রণাঙ্গনের মুখপত্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে বাংলার ডাক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন মাগুরার সাংবাদিক দীপক রায় চৌধুরী । পত্রিকাটি ভারতের রানাঘাট মহকুমার একটি প্রেস থেকে ছাপা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যেত। পত্রিকাটিতে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের কাহিনী প্রকাশিত হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক: মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সৈয়দ আতর আলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে মারা যান। তাকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এনে দাফন করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী মরহুম সোহরাব হোসেন, এমপি মরহুম এডভোকেট আছাদুজ্জামান, সাবেক মহকুমা প্রশাসক ওলিউল ইসলাম প্রমুখ মক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কথাঃ মাগুরা শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স হয়েছে। কিন্তু যাদের গৌরবগাঁথা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই কমপ্লেক্স নির্মাণ, তারা কি আজ ভালো আছেন। না, নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মাগুরার জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই আজ ভালো নেই। আর্থিক অনটনে পরিবারসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। অনেকে রিক্সা চালাচ্ছেন, শ্রমিকের কাজ করছেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতার সামান্য অর্থে তাদের নিজেদেরই চলে না, পরিবারের তো দূরের কথা। তাদের দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক, দুস্থ ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা গণ কবরগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের দাবিও জানিয়েছেন স্বাধীনতার এই সূর্য সন্তানেরা।